ওয়ারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেম- তারবিহীন বিদ্যুৎ



“বিদ্যুৎ” শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে আসে পরিবাহী নিয়ে দাড়িয়ে থাকা ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন লাইনের চিত্র। কখনো কি ভেবে দেখেছেন বিদ্যুৎ যদি মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ায় তাহলে ব্যাপারটি কেমন হবে? পাওয়ার সিস্টেমের খুব জরুরি বিষয় হল সিস্টেম লস। পরিবাহীর মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের মধ্যে প্রধান অন্তরায় হল পরিবাহীর রোধ। যাকে বিদ্যুৎ জগতে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ভিলেনের শক্তি অর্থাৎ রোধ যত বেশি হবে ততই ঝামেলার উদ্ভব হবে। তাই বহুকাল পূর্বে বিজ্ঞানী টেসলা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন উপায়ে পরিবাহী ছাড়াই বিদ্যুৎ সঞ্চালনের প্রস্তাব করেন।

ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন কি?

“ওয়্যারলেস” শব্দটির অর্থ হল তারবিহীন। ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন বলতে পরিবাহীর সাহায্য ছাড়াই সোর্স থেকে লোড পর্যন্ত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা বোঝায়। পাহাড়ি, দ্বীপ অঞ্চল অর্থাৎ যেসব জায়গায় পোল বা টাওয়ার বসানো কষ্টকর সে সমস্ত জায়গায় এই প্রযুক্তি দারুণভাবে সাহায্য করবে।

ইতিহাস

১৮৯৯ সালে নিকোলা টেসলা সর্বপ্রথম পরিবাহীবিহীন বিদ্যুৎ সঞ্চালনের প্রস্তাব রাখেন। তিনি রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি রেজোনেন্ট ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করে সর্বপ্রথম তারবিহীন বিদ্যুৎ সঞ্চালনের প্রচেষ্টা করেন যেটি “টেসলা কয়েল” নামেও পরিচিত। অতঃপর ১৯০১ সালে তিনি একটি প্রটোটাইপ হাই-ভোল্টেজ এর তারবিহীন ট্রান্সমিশন টাওয়ার তৈরি করলেন যেটা Warden clyffe Tower নামে পরিচিত ছিল। এর মাধ্যমে তিনি তথ্য এবং বিদ্যুৎ উভয় প্রেরণে সক্ষম হন।

অতঃপর ১৯৬১ সালে উইলিয়াম সি ব্রাউন মাইক্রোওয়েব পাওয়ার ট্রান্সমিশনের উপর একটি আর্টিকেল প্রকাশ করেন।

২০০৯ সালে সনি কোম্পানি ইলেক্ট্রোডায়নামিক ইন্ডাকশন পাওয়ার টিভি তৈরি করে যার বৈদ্যুতিক ক্ষমতা ছিল ৬০ ওয়াট।

ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশনের পদ্ধতি

বিভিন্ন বিজ্ঞানী নানা উপায়ে ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন এর প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপায় হল দুইটি। যথা-

  • টেসলার কন্ডাকশন পদ্ধতি।
  • ইলেক্ট্রোডায়নামিক ইন্ডাকশন পদ্ধতি।

ইলেক্ট্রোডায়নামিক ইন্ডাকশন পদ্ধতি আবার দুই ধরনের। যথা-

১) মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতি ২) লেজার পদ্ধতি

টেসলার কন্ডাকশন পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা একটি নিয়ন গ্যাসপূর্ণ বাতি জালাতে সক্ষম হয়েছিল যা সোর্স থেকে ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। এই কাজের জন্য তিনি একধরনের ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন টাওয়ার তৈরি করেছিলেন যা “Warden Clyffe” নামে পরিচিত ছিল। এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্সমিটার এবং পরিবেশের মধ্যে একটি আয়নিত পথ তৈরির মাধ্যমে একটি আবদ্ধ বর্তনী তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও রিসিভার প্রান্তের সাথে আরেকটি আয়নিত পথ সংযুক্ত ছিল। উচ্চ বিভববিশিষ্ট ট্রান্সমিটারটি এক ধরনের ইলেক্ট্রোমোটিভ পালস বিকিরণ করে যা পরিবেশের বায়ুকে আয়নিত করে। অত:পর বায়ুর আয়নিত পথটি এক ধরনের নিয়ন টিউবের মত কাজ করে

ওয়্যারলেস পাওয়ার ; টেসলার কন্ডাকশন পদ্ধতি
টেসলার কন্ডাকশন পদ্ধতি

এই প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা

  • ব্যয়বহুল পদ্ধতি।
  • পরিবেশের আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল।
  • সর্বদা হাইভোল্টেজ ট্রান্সমিশন বজায় রাখতে হয়।

ইলেক্ট্রোডায়নামিক ইন্ডাকশন পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে মাইক্রোওয়েভ অথবা লেজার বীম এর সাহায্যে বিদ্যুৎকে সুনিয়ন্ত্রিত এবং সোজা পথে রিসিভার প্রান্তে পৌছে দেয়া সম্ভব।

লেজার বীমের মাধ্যমে

এই পদ্ধতিতে ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যালকে লেজার সিগন্যাল এ রূপান্তর করে উচ্চভেদন ক্ষমতা বিশিষ্ট লেজার বীম তৈরি করা হয়। অত:পর এই লেজার বীমকে বায়ুপথে সঞ্চালিত করে সোলার রিসিভার প্রান্তে প্রেরণ করে পুনরায় ব্যবহারের উপযুক্ত বৈদ্যুতিক সিগনালে রুপান্তর সম্ভব।

মাইক্রোওয়েভ পদ্ধতি

ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেক্ট্রামে 0.3 থেকে 300 GHz কম্পাংক বিশিষ্ট তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গকে মাইক্রোওয়েভ বলে। এই পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক সিগন্যালকে মাইক্রোওয়েভ সিগন্যালে রুপান্তরিত করে তা unidirectional পথে লোড বা রিসিভার প্রান্তে পৌছে দেয়া যায়। অতঃপর এই মাইক্রোওয়েভ সিগন্যালকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রুপান্তর করা হয়। যে ডিভাইসের সাহায্যে মাইক্রোওয়েভকে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে রুপান্তরিত করা হয় তার নাম রেক্টেটিফায়িং এন্টেনা। স্যাটেলাইট এর ব্যাটারি সেল চার্জ করার জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা চলছে।

ওয়্যারলেস পাওয়ার; ইলেক্ট্রোডায়নামিক ইন্ডাকশন পদ্ধতি
ইলেক্ট্রোডায়নামিক ইন্ডাকশন পদ্ধতি

এই প্রযুক্তির প্রয়োগক্ষেত্র

  • ইলেকট্রিক অটোমোবাইল চার্জিং।
  • কনজুমার ইলেকট্রনিক্স।
  • ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কাজে।
  • প্রতিকূল পরিবেশে।
  • সোলার পাওয়ার স্যাটেলাইট চার্জিং।
  • দুর্গম অঞ্চল বিদ্যুতায়ন।
  • এক দেশ থেকে অন্য দেশে সহজেই বিদ্যুৎ প্রেরণ।

ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন এর সুবিধা

  • কার্যকরী পদ্ধতি।
  • সহজ।
  • গ্রীড, সাবস্টেশন এর প্রয়োজন হবেনা।
  • অল্প খরচের প্রজেক্ট।
  • দুর্গম অঞ্চলে বিদ্যুৎ সহজে পৌঁছে দেয়া সম্ভব।

অসুবিধা

  • লেজার সিগন্যাল ব্যবহার করলে absorption loss হবার সম্ভবনা থাকে।
  • মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করলে তা অন্যান্য রেডিও সিগন্যাল এর সহিত interference তৈরি করতে পারে।
  • Field strength সর্বদাই নিরাপদ লেভেল রাখতে হয়। অন্যথায় মানবজীবনের জন্য তা ক্ষতিকারক হতে পারে।

পৃথিবীর কোন দেশে এই প্রযুক্তি চালু আছে?

নিউজিল্যান্ড এই প্রযুক্তি বর্তমানে ব্যবহার শুরু করেছে। নিউজিল্যান্ড এর Emrod Company এই প্রযুক্তিটির বাস্তবায়ন করে। এটি মূলত মাইক্রোওয়েভ ইলেক্ট্রোডায়নামিক ইন্ডাকশন সিস্টেম। এই সিস্টেমে কিলোওয়াট পাওয়ার রেডিয়েশান সম্ভব হচ্ছে এবং এই কোম্পানি এই ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণে আশাবাদী। এই সিস্টেমে ট্রান্সমিটিং এন্টেনা, রিলে, রিসিভিং রেক্টিফায়িং এন্টেনা ব্যবহার করা হয়েছে যার মাধ্যমে মাইক্রোওয়েভ সিগন্যাল ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে রুপান্তরিত হবে।

ওয়্যারলেস পাওয়ার ; নিউজিল্যান্ডে ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেম
নিউজিল্যান্ডে ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেম

Post a Comment

Previous Next

نموذج الاتصال