আগামীর মহাকাশ
মহাকাশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভাবনার শেষ নেই। মহাকাশে মানুষের অগ্রগতির ফলে এটা বলা কঠিন যে, মহাকাশে আগামী দিনে আর কি কি হবে? বিশাল ও বিস্ময়কর রহস্য ভান্ডারের দরজা খুলে গেছে চার দশকের ও বেশি সময় আগে থেকেই। কিন্ত তার পরও মানুষের অগ্রগতি একেবারে কম নয়।
১৯৬৯ সালে মানুষ চাঁদে গেলো। মঙ্গল ও শুক্রে অবতরন করলো মানুষের তৈরী মহাকাশযান। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহকে মহাকাশযান দ্বারা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এমনকি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কোথায় কোন বস্তুটি মানুষের উপকারে লাগতে পারে তা নিয়েও চলছে বিস্তর গবেষণা। মনে হচ্ছে একুশ শতকে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে আরও তাৎপর্যপূর্ন অগ্রগতি ঘটবে। তবে ভবিষ্যতের কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। তবুও এ কথা দৃঢ়ভাবেই বলা যেতে পারে নিখিল বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এ শতক থেকেই নিবিড় হতেই শুরু করবে এবং অদূর ভবিষ্যতে মহাবিশ্বকে মানুষের উপনিবেশে পরিণত করাটা মোটেই আর অসম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
পৃথিবী সম্পর্কে আরও বেশি জানার কাজেও মহাকাশ গবেষণা আমাদের সাহায্য করবে। এ উদ্দেশ্যে নাসা বিশ্ব পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছে। পৃথিবীর পরিবেশ সম্পর্কে ব্যাপক গবেষনার জন্য এ সম্পর্কিত পুরো চিত্র আমাদের দরকার। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীর ৫৯৫ কিলোমিটার উপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই টেলিষ্কোপের পাঠানো চিত্র থেকে জ্যোর্তিবিদরা ভূত্বকের রাসায়নিক সংমিশ্রণ ও কোন ধরনের কি কি পদার্থ দিয়ে ভূত্বক গঠিত সে সম্পর্কে আরও ষ্পষ্ট তথ্য পাচ্ছেন এখনই। হাবলের শক্তি ক্ষমতা আরো বাড়ানো হলে এটাই হয়ে ওঠবে একুশ শতকের একটি প্রধান মহাকাশ পর্যবেক্ষন কেন্দ্র।
চিত্রঃ হাবল স্পেস টেলিস্কোপ
তবে ওজনহীন অথবা স্বল্প ওজনের অবস্থা নিয়ে যেসব গবেষণা চলছে তার কার্যকারিতা খুব বেশি এর ফলে মহাশুন্যে বিজ্ঞানিরা আরও নিখুঁত ও বড় মাপের স্ফটিক তৈরী করতে পারবেন। তাছাড়া সেখানে স্বাধীনভাবে বিভিন্ন পদার্থের অভিনব সব ককটেল ঔষধ তৈরী করা যাবে। এসব নতুন নতুন ধাতুর সমন্বয়ে আরও ক্ষুদ্র, আরো হাল্কা, আরো কার্যকর ইলেকট্রিক মোটর চিপস পার্টস ইত্যাদি তৈরী করা সম্ভব হবে। বিভিন্ত ধরনের ঔষধ সামগ্রী যেমন এ্যান্টি-ক্যান্সার ড্রাগ ইন্টারফেরন্ন, গ্রোথ হরমোন, কিডনির জন্যে ইরিথ্রোপ্রোটিন উপাদান উন্নত ও কার্যকর সংকরণ মহাশুন্যে আরো দক্ষভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হবে। মহাশুন্যে বস্তুবিজ্ঞানের গবেষণা আগামি দশ-পনের বছরের মধ্যেই অর্থনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপুর্ন হযে উঠবে বলে আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানিরা জোর আশা করছেন।
তবে মহাকাশযাত্রায় গবেষণাকারী সকল দেশেরই একটি সাধারন ও প্রধান সমস্যা এখনো রয়েই গেছে। আর তা হচ্ছে যাতায়াত সমস্যা। সমস্যাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য এ্যারোস্পেস বিমান ও কার্গো যানের নতুন প্রজন্ম তৈরী চেষ্টা চলছে। এজন্য দরকার টেকসই জ্বালানি যা পুনরাই ব্যবহার যোগ্য হবে। এজন্য জাপানে তৈরী হচ্ছে খরচ সাশ্রয়কারী সিঙ্গেল ষ্টেজ টু অরবিট যান। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকগুলো দেশ এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ রকমি যান তৈরী সম্ভব হলে মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে সত্যিকারে বিপ্লব ঘটে যাবে। এসব বিমান সাধারন জেট বিমানের মতোই ওঠা নামা করবে। তবে সে ক্ষেত্রেও পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে ভেদ করার মতে পর্যাপ্ত শক্তি লাগবে।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এরোস্পেস বিমানগুলো চলাচল শুরু করলে মহাকাশ হোটেলের ধারনাও বাস্তব রূপ লাভ করবে। বিশ্বের বৃহত্তম নির্মাণ কোম্পানি জাপানের শিমিজু করপোরেশন মহাকাশে বানিজ্যিক লাভের কথাটা আগে ভাগেই ভেবে রেখেছে। আগামি ২০২৫ সালের মধ্যেই তারা এ রকম একটি হোটেলের মহাকাশে স্থাপন করবে। শিমিজু একই সঙ্গে ৬৭৪ অতিথির ছয় দিনের ভ্রমনের সুবিধার একটি পরিকল্পনা তৈরী করে ফেলেছেন এসময় অতিথিরা আড়াই দিন হোটেলের বাইরেও কাটাতে পারবেন। এসব হোটেলের কক্ষগুলো হবে বিলাসবহুল। মহাকাশে অতিথিদের বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। মহাকাশে হাটাহাটি করা থিয়েটারে কার্যক্রম, এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানে আয়োজনও করা সম্ভব হবে। হোটেলে স্বল্প মধ্যাকর্ষণ পরিবেশে ষ্কোয়াশ ও হ্যান্ডবলের আয়োজন করা যাবে মিশিজু কর্পোরেশন জানায়। বিনোদনের উৎস হিসাবে ভিন্ন ধরনের সুইমিং পুলও তারা বানাবে।
আসলে মহাকাশ কি আমাদের মতো আম জনতার জন্য কোন এনে দেবে না? শুধু এখনই আমাদের শক্তি সম্পদের প্রয়োজন দু হাজার গিগাওয়াট। ২০৩০ সালের মধ্যে এই প্রয়োজন বেড়ে চারগুন হবে। অথচ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে পৃথিবীর খনিজ সম্পদ। পৃথিবী থেকে বিকল্প সম্পদ জোগড়ের উৎসও সীমিত। বাতাস ও পানি থেকে, সমুদ্র ও ভূ-পৃষ্ঠ থেকে শক্তি আহরণ করে অভাব পূরন করা যাবে না। পরমানু বিভাজনে ফিউশন উৎস গুলো তেমন আর্কষণীয় নয়। এমন কি সস্তা ও অফুরন্ত আনবিক শক্তি ও আমাদের শক্তি সমস্যার আর্শ্চর্য কোন সমাধান দিচ্ছে না। প্রতিটি এক গিগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন শক্তি ৬ হাজার নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টর তৈরী করেও সমস্যার সমাধান হবে না।
তবে উপায় একটি আছে। সৌরশক্তি চালিত উপগ্রহগুলোর একটি নেটওয়ার্ক কাঙ্খিত সমাধান দিতে পারবে বলে বিজ্ঞানীরা জানান। এই উপগ্রহ গুলো পৃথিবীতে শক্তি প্রেরন করবে। এখানে এ শক্তি বিদ্যুতে রুপান্তরিত হয়ে টার্গেট দেশের জাতীয় গ্রিডের মধ্য দিয়ে সরাসরি সঞ্চালিত হতে থাকবে। পৃথিবীতে এ শক্তি ট্রান্সমিটারের জন্য ব্যবহৃত হবে সুপার হাই ফ্রিকোয়েন্স মাইক্রোওয়েভ ও লেজার। তবে উপগ্রহ চাঁদ কিন্তু ধাতু ও খনিজের অসীম উদার উৎস। দরকার হলো চাঁদের এ অফুরন্ত ভান্ডারকে কাজে লাগানো। চাঁদের বাসিন্দাদের বেচেঁ থাকার জন্য পানি দরকার। বিষয়টি বিজ্ঞানিরা ভেবেছেন কেমিক্যাল ইন্জিনিয়াররা তাই পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করতে চাঁদের শিলাকে মিথেন দিয়ে উত্তপ্ত করার পদ্ধতি উদ্ভাবণ করেছেন এরপর অক্সিজেন তৈরি করতে এটাকে তডিৎ বিশ্লেষণ করার পদ্ধতিও বের করা হয়েছে। এভাবে মুক্ত করা অক্সিজেনকে তরল করা হবে।
আসল কথা হলো, চাঁদে কবে পূর্ণাঙ্গ ঘাঁটি তৈরি হবে? বিজ্ঞানিদের মতে ২০২৫ সালের মধ্যেই এটি সম্ভব। পরীক্ষামূলক এই ঘাঁটি তৈরি করতে যে যে প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা দরকার তা সৌরজগতে প্রবেশ করতে কাজ লাগবে চাঁদ কিন্তু আরো বোমাঞ্চকর সব সুবিধার দ্বারাও খুলে দেবে। পৃথিবীর বেতার তরঙ্গে হৈ হট্টগোল থেকে দুরে একটি রেডিও ডিস নেটওর্য়াক চাঁদের ভূখন্ডেই উপন্ন হবে । ফলে রেডিও এ্যাম্ট্রোনোমারদের আয়ত্বের মধ্যে এমন ক্ষমতা আসবে যা আগে অকল্পনীয় ছিল।
একুশ শতকের কোন এক সময় মঙ্গলের পা রাখবে প্রথম মানব। ২০৩৫ সালের মধ্যে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার সেটাই হবে মানব জাতির ভবিষ্যৎ অগ্রগতির জন্যে পদক্ষেপ। বদ্ধ পরিবেশের জীবন সমহায়ক ব্যবস্থা,আন্ত প্রতিলিপি তৈরিতে সক্ষম যন্ত্র ছাড়া মঙ্গলে উপনিবেশ স্থাপনের কথা ভাবা যায় না। পৃথিবী মঙ্গল ও সূর্যের মধ্যে যে পারস্পবিক আন্ত: ক্রিয়া কাজ করে তা শোষণ করা হবে।ফলে বড় বড় বাহক যান আন্ত: নাক্ষত্রিক রাজপথে ধরে নিয়মিত ছোটাছুটি করবে। শীঘ্রই গ্রহানুগুলোতে স্পেস গ্রোব পাঠানো হবে।ফলে এগুলোর রাসায়নিক গঠণ জন্য যাবে চারদিকে আধা কিলোমিটার ব্যাস সম্পন্ন একটি সাধারন গ্রহানুতে ৭ বিলিয়ন টন লোহা, ১ বিলিয়ন টন নিকেল ও প্রচুর কোবাল্ট থাকতে পারে যা আগামী তিন হাজার বছর পৃথিবীতে পাঠানো হবে।
এমনকি সস্তা, নবায়নযোগ্য ও দুষণমুক্ত পদ্ধতিতে গ্রহানুর ব্যাবহার করা যাবে। একুশ শতকেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মহাকাশযানকে সৌরজগতের দুর্গম ও বিপজ্জনক এলাকা গুলোতে স্থাপন করা হবে। আত্ম প্রকৃতি তৈরী সক্ষম যন্ত্রগুলো সৌর সম্পদ ব্যবহার করে প্লুটো ও তার বাইরে মানুষের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে।
তাছাড়া ন্যানোটেকনোলজির সাম্প্রতিক অগ্রগতির ফলে কমলা আকৃতির মহাকাশযানের একটি বিরাট বহরকে পৃথিবীর কক্ষপথের নিচে স্থাপন করা যাবে। এটা নেটওয়ার্ক কমিউনিকেশন এর রিলে হিসাবে কাজ করবে। তখন এখনকার মতো আর কক্ষপথে বহু লাখ ডলার ব্যায়ে যোগাযোগ উপগ্রহ স্থাপন করতে হবে না। বেশিদিন লাগবে না। ২০৬০ সালের মধ্যে সৌরজগতে দ্রুততগতির রোবটযান ঘুরে বেড়াবে। এ রোবটযান গুলো হাতের কাছে পাওয়া কাঁচামাল দিয়ে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরী করবে। গ্রহানুতে নেমে এর ঝটপট নিজেদের ক্লোন বানিয়ে ফেলবে। এগুলোর কোনটির কাজ হবে কাঁচামাল প্রসেস করা, আবার কোন কোনটি জব শপ হিসাবে কাজ করবে। অর্থাৎ এগুলোতে সব উপাদান জুড়ে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, সৌরজগতের বাইরে এন্টি ম্যাটার রকেটই হবে সবচেয়ে দ্রুত ও দক্ষ চালক। ২০৬০ সালের মধ্যেই এক গ্রামের মূল্যবান বস্তু তৈরী করা যাবে। যা আমাদের ঠিক এ্যান্টি ম্যাটার প্রপালশন তৈরী করতে সক্ষম করবে ফলে ১ মাস সময়ের মধ্যেই যে কোন নক্ষত্রে যাওয়া কোন ব্যাপারই আর হবে না। আশা করা যায়, ২০৭০ সালের মধ্যেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর অগ্রগতির কাজগুলো চালানো হবে মহাশুন্যে। ফলে মানুষের আয়ু বাড়বে। এখন এই কাজটি পৃথিবীতে করা যাচ্ছে। মহাকাশ যানের বেগকে অগ্রাহ্য করে সব আরোহী ও ক্ররা সহজেই গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবে। মহাশুন্যে তৈরীকৃত নতুন বায়লজিক্যাল কৌশল আমাদের এক জীবনেই অসীম মহাশূন্যের দুর নক্ষত্র ভ্রমনে সাহায্য করবে। প্রজন্মের ব্যাবধানে মানুষের শরীর শূন্য মাধ্যাকর্ষণের তীর্বতার সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো করে বদলে ও যেতে পারে বলে বিজ্ঞনীদের অভিমত।
তবে দূর ভবিষ্যতের এই চিত্র সম্পর্কে সঠিক সব ধারনা পাওয়া এখনই অসম্ভব হলেও কিছু কিছু ধারনা পাওয়া যাচ্ছে। সবগুলো পেতে হয়তো হাজার বছর ও লেগে যেতে পারে। আগামী বছরের পৃথিবীর আবহাওয়ার মতো হয়ে উঠতে পারে মঙ্গলের আবহাওয়া। তাছাড়া বৃহস্পতির উপগ্রহ গ্যানিমেড ও ক্যালিস্টোকে বসবাসযোগ্য করে তোলাও হতে পারে। কারণ, এগুলোতে পানির অস্থিত্ব রয়েছে।
আগামী একশ বছরে মানুষের মহাকাশ জয়ের ধারাটি কোন দিকে যাবে বা কতটুকু সফল হবে সে ব্যাপরে আগাম কিছু বলা সত্যিই অসম্ভব। পৃথিবীর বাইরের দুর কোন গ্রহ বা নক্ষত্রে বুদ্ধিমান কোন প্রাণীর সাথে ততোদিনে আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হতেও পারে। যদি হয় তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার। কোন বুদ্ধিমান প্রতিবেশি বন্ধু পাওয়া গেলে একটাই লাভ হবে তা হচ্ছে, আমাদের ভাবনা চিন্তাগুলোকে তাদের চিন্তার সাথে মিলিয়ে নেয়া যাবে। আর এক যোগে কাজও করা যাবে।
কে জানে, একথা সত্যিই সম্ভব হবে কিনা ! হয়তো আরো অগ্রগতির ফলে একদিন এই সব সম্ভব হতেও পারে।