ক্লোন এবং ক্লোনিং কি?
আমরা যারা বায়োলজিতে পড়ি অথবা যারা হলিউড প্রেমী তারা হয়তো সবাই কম বেশি ক্লোনিং অথবা ক্লোন শব্দ গুলোর সাথে পরিচিত, তবুও সবার জানার জন্য বলছি, “ক্লোন” শব্দের অর্থ “অনুরূপ প্রতিলিপি” আর ক্লোনিং হলো ক্লোন তৈরির প্রক্রিয়া। একটু ভাল করে বললে, ক্লোনিং হলো অতি অত্যাধুনিক একটি প্রযুক্তি যার মাধ্যমে একটা প্রাণীর ক্রোমোজোম বা ডিএনএ (কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত এক বিশেষ ধরনের জৈব অ্যাসিড যা একটি জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে –জন্ম, মৃত্যু, চেহারা, আকার-আকৃতি, আচার ব্যবহার, বেড়ে উঠা ইত্যাদি) ব্যবহার করে হুবহু সেই প্রাণীর অনুরূপ আরেকটি প্রাণী করা হয় – যা জেনেটিক এবং ফিনোটাইপিক উভয় দিক থেকেই অনুরূপ হবে। সোজা কথায় ক্লোনিং হল কোন জিনগত ভাবে কোন কিছুর হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করা।
বিভিন্ন প্রকার ক্লোনিং পদ্ধতি
এক ধরনের ক্লোনিং পদ্ধতি সব ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিতে পারেনা, বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ক্লোনিংয়ের মূলনীতি ঠিক রেখে বিভিন্ন প্রকার ক্লোনিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রধান কয়েকটি ক্লোনিং পদ্ধতি নিচে বর্ননা করা হলঃ
সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফারঃ এটাই ক্লোনিং এর মুল পদ্ধতি, বাকিগুলো বিভিন্ন সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে এই পদ্ধতিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় মূলত প্রথমে একটি দেহকোষ (2n) ও একটি ডিম্বাণু (n) সংগ্রহ করা হয়। তারপর দেহকোষ থেকে নিউক্লিয়াসটি পৃথক করা হয়, অপরদিকে ডিম্বাণুটির নিউক্লিয়াসটি ফেলে দেওয়া হয় এবং শুধু নিউক্লিয়াস বিহীন ডিম্বক কোষটি রাখা হয়। অতঃপর দেহকোষ থেকে পৃথককৃত নিউক্লিয়াসটি নিউক্লিয়াস বিহীন ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর বৈদ্যুতিক শক প্রদানের মাধ্যমে নিষেক প্রক্রিয়া শুরু করানো হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় টেস্টটিউবের ভেতরে। নিষেক এবং স্বাভাবিক কোষ বিভাজন শুরু হলে, স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে পরিণত হওয়ার জন্য উক্ত ভ্রূণটি জরায়ুতে/মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর ভ্রূণটি গর্ভে বেড়ে উঠে এবং জন্মগ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, এক্ষেত্রে দেহকোষ, ডিম্বাণু, ও জরায়ু তিনটিই একই প্রাণীর হতে পারে আবার নাও পারে।
রস্লিন পদ্ধতিঃ এটাও সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফারের মত তবে সামান্য একটু আলাদা। রস্লিন ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা ডলিকে সৃষ্টি করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতির সবকিছুই আগের পদ্ধতির মত, তবে এক্ষেত্রে সংগ্রহকৃত দেহকোষটিকে প্রথমে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিভাজন হতে দেওয়া হয়, এবং এক পর্যায়ে খুব কম পরিমাণ নিউট্রিয়েন্ট (পুষ্টি পদার্থ) সরবরাহ করা হয় যাতে সেলটি নিষ্ক্রিয় ধাপে (G0 Stage) চলে যায়। অতঃপর ডিম্বক কোষটি খুব কাছাকাছি রেখে বৈদ্যুতিক শক্ প্রদান করে কোষ দুটিকে একীভূত (Fusion) করা হয়। এরপরের ধাপগুলো মুল পদ্ধতির মতোই।
হনলুলু পদ্ধতিঃ এটা ক্লোনিং এর নতুন পদ্ধতি যদিও এটা সেই মুল প্রক্রিয়ার মতোই। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. তেরুহিকো ওয়াকায়ামা এই পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন। এক্ষেত্রে নিউক্লিয়াস বিহীন ডিম্বাণুতে দেহকোষের নিউক্লিয়াসটি মাইক্রোইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ট্রান্সফার করা হয়। অতঃপর রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করে নিষেক ও কোষ বিভাজন শুরু করানো হয়। তারপর যথারীতি একই পদ্ধতিতে ভ্রূণটি একটি পূর্ণ প্রাণীতে পরিণত হয় এবং ভূমিষ্ঠ হয়।
ক্লোনিংয়ের যত রূপ
ক্লোনিং শব্দটা শুনলেই আমরা যেটার কথা ভাবি সেটা সাধারনত ক্লোনিংয়ের একটা প্রকার মাত্র, অর্থাৎ অরগানিজম ক্লোনিং। কাজের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি তিন প্রকার ক্লোনিং উদ্ভাবন করেছেঃ ১। মলিকিউলার ক্লোনিং, ২। রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং, ৩। থেরাপিউটিক ক্লোনিং
মলিকিউলার ক্লোনিংঃ এ পদ্ধতিতে একটা নির্দিষ্ট ডিএনএ অণুর অনুরূপ আরেকটি ডিএনএ অণু তৈরি করা হয়, এ কারণে এটিকে অনেক সময় ডিএনএ ক্লোনিং বা জিন ক্লোনিং ও বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমে কোন কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ অণুকে নির্দিষ্ট স্থানে কাটা হয়, এরপর, উক্ত (খণ্ডিত ও কাঙ্ক্ষিত) ডিএনএ অণুকে কোন ভেক্টরের (এক ধরনের বৃত্তাকার ডিএনএ অণু যা ব্যাকটেরিয়ার কোষের অভ্যন্তরে পাওয়া যায় এবং এটাকে সাধারণত প্লাজমিড বলা হয়) সাথে জুড়ে দেওয়া হয়, এরপর সেটি পুনরায় ব্যাকটেরিয়ার দেহে প্রবেশ করানো হয়। এখন ব্যাকটেরিয়ার কোষ বিভাজনের সাথে সাথে প্লাজমিড তথা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ অণুটিও কপি হতে থাকবে। প্রাকৃতিক ভাবে আমাদের প্রতিটি কোষেও এই ধরনের ক্লোনিং প্রক্রিয়া চলছে আর এজন্যই আমাদের প্রতিটি কোষের ডিএনএ পুরোপুরি অভিন্ন। তবে PCR এর মাধ্যমে এটা পরীক্ষাগারেও করা সম্ভব। কোন কাঙ্ক্ষিত ডিএনএ নিয়ে কাজ করার সময় এই ক্লোনিং করা হয়।
রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিংঃ এ ক্ষেত্রে একটা পুরা জীবকেই ক্লোন করা হয়, অর্থাৎ সূক্ষ্মভাবে বললে কোন জীবের সম্পূর্ণ জিনোম কেই ক্লোন করা হয়। রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিংয়ে উপরে উল্লেখিত সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। মানব ক্লোনিংও একই পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। আমরা সাধারণত ক্লোনিং বলতে এটাকেই বুঝি। হলিউডের সাম্প্রতিক সাইন্স-ফিকশন মুভি গুলোতে আমরা এই ধরনের ক্লোনিং দেখে থাকি। এটাকে আবার অর্গানিজম ক্লোনিং ও বলে। যেহেতু ক্লোনিংয়ের এই প্রকারটাই সবথেকে বেশি পরিচিত তাই এটা নিয়ে পরবর্তি অংশে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
থেরাপিউটিক ক্লোনিংঃ এটাও অনেকটাই রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং এর মতই, তবে এক্ষেত্রে শুধু ভ্রূণ কে পূর্ন বিকাশিত করা হয়না এবং ভ্রূণকে গর্ভাশয়ে স্থাপন না করে ল্যাবরেটরিতে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয়। নিষিক্ত ডিম্বাণু বিভাজন শুরু করার কয়েকদিন পর এটা থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয়। এ ধরনের ক্লোনিং এর প্রধান উদ্দেশ্য হল স্টেম সেলের উপর গবেষণা করা এবং দেখা হয় যে গবেষণাগারে কৃত্রিম ভাবে এই সেল কে অন্য ধরনের সেলে রূপান্তরিত করা যায় কিনা কারণ এটি যদি সম্ভব হয় তাহলে যে সব রোগ বিভিন্ন কোষের কারণে হয়ে থাকে সেগুলো কৃত্রিমভাবে রূপান্তরিত কোষ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে, ফলশ্রুতিতে রোগটা নিরাময় করা সম্ভব হবে, যেমনঃ আলঝেইমার, যা কিনা নিউরন কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, একটি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীদেহের সকল ধরনের কোষ তৈরি হয় স্টেম সেল থেকে তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রিপ্রোডিক্টিভ ক্লোনিং এবং একটি মেষ শাবকের গল্প
রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং বা অর্গানিজম ক্লোনিং হল কোন প্রাণীর আদলে হুবহু আরেকটি প্রাণী তৈরি করার প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে প্রধানত সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোন প্রাণীর দেহকোষ থেকে নিউক্লিয়াসটি প্রথমত পৃথক করা হয় তারপর এটি একটি নিউক্লিয়াস বিহীন ডিম্বাণু তে প্রবেশ করান হয়, যেটার নিউক্লিয়াসটি আগেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় বের করে ফেলা হয়েছে। তারপর ডিম্বাণুটি তে রাসায়নিক পদার্থ অথবা বৈদ্যুতিক শক্ প্রয়োগ করে নিষেক ও কোষ বিভাজন শুরু করা হয়, অতঃপর সেটিকে একটি উর্বর জরায়ুতে/মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গর্ভে বেড়ে উঠে এবং সঠিক সময়ে ভূমিষ্ঠ হয়। এভাবে উৎপন্ন বাচ্চাটি কোষ দাতার (দেহকোষ) মত হয়ে থাকে।
এখন আমরা জানবো কেন এই দুইটা প্রাণী হুবহু একই হবে। সত্যি বলতে এটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটা সহজ মোটেই নয় তবে মূলনীতিটা মোটামুটি সহজ। এই প্রক্রিয়া বুঝতে গেলে আমাদের আগে জানতে হবে যে, একটা প্রাণী কেমন দেখতে হবে বা তার সকল বৈশিষ্ট কেমন হবে তা ৯৯% নির্ভর করে তার তার দেহকোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ক্রোমোজোমের উপর আর বাকিটা পরিবেশের উপর। এখন আমরা যদি একটি প্রাণীর আদলে আরেকটি প্রাণী তৈরি করতে চাই তাহলে প্রথমেই আমাদের দুটি প্রাণীর ক্রোমোজোমে সাদৃশ্য নিয়ে আসতে হবে – ক্রোমোজোম যতোটা মিল হবে তাদের বৈশিষ্ট্য গুলোও ততটা মিলে যাবে। অর্থাৎ, সোজা কথায় দুটি প্রাণীর জিনোম (সম্পূর্ণ ক্রোমোজোম) যদি একই হয় তাহলে তাদের সবকিছু একই হবে – চেহারা, গঠন, চরিত্র ইত্যাদি। সাধারণত, প্রকৃতিতে আমরা তেমনটা খুব একটা দেখিনা কারণ, স্বাভাবিক প্রজনন হয় শুক্রাণু (n) ও ডিম্বাণুর (n) মিলনের ফলে – এই দুটি কোষই বিশেষায়িত কোষ কারণ এদের প্রতিটিতেই ক্রোমোজোমের পরিমাণ থাকে দেহ কোষের অর্ধেক (n) সংখ্যক অর্থাৎ এরা হ্যাপ্লয়েড সেল, এই দুটি কোষ মিলেই তৈরি হয় পরিপূর্ণ দেহকোষ (2n) অর্থাৎ ডিপ্লয়েড সেল। তাহলে এখন প্রশ্ন জাগতে পারে ক্লোনিং এর ক্ষেত্রে এই মূলনীতি বজায় থাকছে কিভাবে যেহেতু আমরা একটি প্রানি থেকেই শুধু কোষ নিচ্ছি ? ক্লোনিং ক্ষেত্রে আমরা দেহকোষ ব্যবহার করছি আর দেহকোষে (2n) সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে, অপরদিকে আমরা ডিম্বাণুটির নিউক্লিয়াসটি ফেলে দিচ্ছি, অর্থাৎ ডিম্বাণুতে কোন ক্রোমোজোমই থাকছেনা। তাহলে, যখন দেহকোষের নিউক্লিয়াস এবং নিউক্লিয়াস বিহীন ডিম্বাণুটির মিলন (2n+0=2n) হচ্ছে তখন তাদের মোট ক্রোমোজোম সংখ্যা হচ্ছে 2n সংখ্যক।
ঠিক এভাবেই তৈরি করা হয়েছিল ডলি। না, এটা কারো প্রেমিকার নাম নয়, এটা ছিল একটি মেষ শাবক। ডলির জন্ম হয়েছিল ৫ ই জুলাই ১৯৯৬ সাল এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয় ২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৯৭। ডলির নামকরণ করা হয় বিখ্যাত গায়িকা ডলি পার্টনের নাম অনুসারে এবং ডলির সাঙ্কেতিক নাম (CODE NAME) ছিল 6LL3। ডলিকে তৈরি করা হয়েছিল ক্লোনিংয়ের রস্লিন পদ্ধতিতে যা “সোমাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার” পদ্ধিতিরই একটি বিশেষায়িত রূপ। এডিনবার্গ এর বিখ্যাত রস্লিন ইন্সটিটিউটের ইয়ান উইল্মুট, কেইথ ক্যাম্পবেল এবং তাদের সহকারীরা এই ক্লোন করে। মজার বিষয় হল, ডলির মা ছিল তিনজন – একটির থেকে দেহকোষ, আরেকটি থেকে ডিম্বাণু নেওয়া হয় এবং তৃতীয়টির গর্ভে ডলির ভ্রূণকে বড় করা হয়। প্রথম মাতার (যার অনুরূপ দেখতে হবে) দেহের ম্যামারি গ্লান্ড থেকে কোষ নিয়ে নিউক্লিয়াসটি পৃথক করা হয়, অতঃপর সেটিকে দ্বিতীয় মাতা থেকে প্রাপ্ত নিউক্লিয়াস বিহীন ডিম্বাণুতে স্থাপন করা হয় তারপর বৈদ্যুতিক শক্ প্রদান করা হয় এবং টেস্টটিউবে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ছয়দিন পর যখন দেখা গেল সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে এগুচ্ছে, তখন ডলির ভ্রূণটি তৃতীয় মাতার জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর ডলি স্বাভাবিক ভাবে গর্ভে বেড়ে ওঠে এবং জন্মগ্রহণ করে।
সাধারণত ডলিকে বলা হয় প্রথম ক্লোন কিন্তু এটা মোটেই ঠিক নয়, এর আগেও ক্লোন করা হয়েছে বরং সঠিকভাবে বললে ডলি ছিল পূর্ণবয়স্ক দেহকোষ থেকে তৈরি করা প্রথম ক্লোন। যাহোক, এখানেই গল্পের শেষ নয়, ডলি স্বাভাবিক প্রজননের মাধ্যমে ছয়টি বাচ্চা প্রসব করে – এর মধ্যে প্রথমটির নাম দেওয়া হয়েছিল “বনি” যেটার জন্ম হয়েছিল এপ্রিল ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সালে ডলি আরথ্রাইটিসে আক্রান্ত হয় এবং কয়েক মাসের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠে। এরপর অনেকদিন সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু ২০০৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারী আবার ডলি অসুস্থ হয়, সিটি স্ক্যান (CT Scan) করানো হয়। সিটি স্ক্যানে ডলির বুকে টিউমার ধরা পড়ে যেটা আরোগ্য করা সম্ভব নয়। যেহেতু ডলিকে বাঁচানো যাবেনা তাই টেস্টে ব্যবহারিত অ্যানেস্থেসিয়ার (চেতনা নাশক পদার্থ) পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে ডলির জ্ঞান আর না ফিরে আসে। যদিও ডলির সম্ভাব্য জীবন কাল ধরা হয়েছিল ১১ থেকে ১২ বছর (একটি স্বাভাবিক ভেড়ার জীবনকাল ১০-১২ বছর) কিন্তু মাত্র সাড়ে ৬ বছর পরেই ১৪ই ফেব্রুয়ারী ২০০৩ সাল, শুক্রবার ডলি ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় (সত্যি বলতে, মেরে ফেলা হয়)। ডলি মারা যাওয়ার পর তার ব্যবহারিত সবকিছু স্কটল্যান্ডের জাতীয় যাদুঘরে রাখা হয়।
ক্লোন কি আসলেই ক্লোন!
ক্লোন বলতে আমরা বুঝি একটা প্রাণীর হুবহু প্রতিলিপি কিন্তু ক্লোনিং পদ্ধতিতে তৈরি করা প্রাণী কি আসলেই পুরোপুরি পূর্বের প্রাণীর মত হবে ? না হবেনা, জিনগত দিক থেকে তো অবশ্যই নয়। কারণ, এক্ষেত্রে আমরা দাতার দেহ কোষ থেকে শুধুমাত্র নিউক্লিয়াস তথা ক্রোমজোমটাই নিচ্ছি, অপরদিকে, অন্য প্রাণী থেকে প্রাপ্ত ডিম্বাণু থেকে শুধুমাত্র নিউক্লিয়াসটি বাদ দিচ্ছি কিন্তু ডিম্বাণুতে মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে যাচ্ছে – মাইটোকন্ড্রিয়াতেও ডিএনএ বা জিন আছে এবং সেগুলো খুব দুর্লভ কিছু ক্ষেত্রে ফিনোটাইপিক ইফেক্ট দিতে পারে। সত্যি বলতে কি! মাইটোকন্ড্রিয়া কে বাদ দিয়ে ক্লোনিং করা সম্ভবও না কারণ মাইটোকন্ড্রিয়া কোষের সকল শক্তির উৎস – মাইটোকন্ড্রিয়া কে অপসারন করলে কোষটি মারা যাবে। তাই ক্লোন তার দেহের প্রতিটা মাইটোকন্ড্রিয়া ওই ডিম্বাণু থেকেই পেয়ে থাকে। সবথেকে মজার বিষয়, সেক্সুয়াল রিপ্রোডাকশনের (যেহেতু, শুক্রানুর নিউক্লিয়াস সম্বলিত মাথাটাই শুধুমাত্র ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করে) ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে – অর্থাৎ, আমরা আমদের দেহের সব মাইটোকন্ড্রিয়া আমাদের মাতার কাছ থেকে পেয়েছি, তারাও পেয়েছে তাদের মায়ের কাছ থেকে। তবে ক্লোনিং এর ক্ষেত্রে দেহকোষ এবং ডিম্বাণু যদি একই প্রাণী থেকে নেওয়া হয় তাহলে ভিন্ন কথা।
মাতার গর্ভের পরিবেশও জীবের অনেক কিছুই নির্ধারণ করে যেমন, মানসিক বিকাশ। ক্লোন করা জীব কে ফিনোটাইপিক দিক থেকে দেখলেও কিছু অসাদৃশ্য দেখা যেতে পারে, যেমন মানব শিশুর ক্ষেত্রে আঙ্গুলের ছাপ (এটা মাতার গর্ভের পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়) । সুতরাং, দাতার জিনোমের সাথে নতুন উৎপন্ন ক্লোনের জিনোমের একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য থেকেই যায়। তাই আপাত দৃষ্টিতে কোন ক্লোনকে ১০০% একই রকম দেখতে হলেও আসলে জিনগত দিক থেকে তারা পুরোপুরি হুবহু প্রতিলিপি নয়। তবে, প্রকৃতিতে আপনা-আপনিই সম্পূর্ণ সদৃশ ও নিখুঁত ক্লোন তৈরি হতে পারে – মোনোজাইগোটিক টুইন বা সদৃশ যমজ কারণ এক্ষেত্রে তাদের মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম ও একই।
ক্লোনিং সম্পর্কিত কিছু জটিলতা
যদিও ক্লোনিংয়ে বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট সফল, তথাপি এর সাথে অনেক সমস্যা জড়িত, যেমন, ডিম্বাণুতে নিউক্লিয়াস ট্রান্সফার প্রক্রিয়ার পুরোটাই ম্যানুয়ালি করতে হয়, কোন অটোমেটেড প্রক্রিয়া নেই, একারণে অনেক ডিম্বক নিষেক করার সময়ই নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া একটা বড় সমস্যা হল ক্লোনিং পদ্ধতিতে উৎপন্ন জীবের টিকে থাকার সম্ভাবনা এবং তাদের বেঁচে থাকার সময় সীমা নিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণী তার ভ্রূণ অবস্থাতেই মারা যায় আর যারা সারভাইভ করে তারাও বেশি দিন বাচেঁনা (ডলি বেঁচে ছিল মাত্র সাড়ে ৬ বছর)। এর কিছু কারণ আছে, যেমন, ক্রোমোজোমের প্রান্তে টেলোমেয়ার নামক এক ধরনের ডিএনএ থাকে যা প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় কিছুটা করে ক্ষয়ে যায়, অর্থাৎ বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রত্যেক প্রাণীর কোষের টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে। এই টেলোমেয়ার-ই জীবের মৃত্যুর প্রধান কারণ। এটা যখন শেষ হয়ে যায় তখন কোষ বিভাজনে সমস্যা দেখা দেয় এবং কোষটি মারা যায়, পরিশেষে পূর্ণ জীবটাই মারা যায়। যেহেতু বয়স্ক প্রাণীর কোষের টেলোমেয়ার ক্ষয়ে যাওয়ার কারণে এর দৈর্ঘ্য কম থাকে – এখন দেহকোষ যদি এরকম কোন প্রাণী থেকে নেওয়া হয় তাহলে উৎপন্ন ক্লোনটিও সেই একই পরিমান দৈর্ঘ্যের টেলোমেয়ার (Telomeric Length) নিয়ে জন্ম নেবে ফলে তার দেহকোষ কিছুদিন পর তার বাকি টেলোমেয়ার টুকুও হারাবে ফলে জীবটি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে । তবে বর্তমানে ক্লোন করার আগে দেহ কোষটির টেলোমেয়ারকে পরিপূর্ণ করা হয় অর্থাৎ দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে আগের মত করা হয়। এছাড়াও আছে নিউক্লিয়ার জিনোম এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোমের অসামান্জস্যতা, মিউটেশন (ডিএনএ ‘র স্থায়ী পরিবর্তন), কোষের বিভিন্ন প্রোটিন, ফ্যাক্টর, অন্যান্য মলিকিউলস গুলোর মধ্যকার মিথষ্ক্রিয়াসহ ইত্যাদি অনেক কারণ।
মানব ক্লোনিং
ক্লোনিং পদ্ধতিতে মানব শিশু তৈরি (যা হবে কোষদাতার অনুরূপ প্রতিলিপি) করাকে মানব ক্লোনিং বলে । ক্লোন মানব শিশুর জন্ম পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া পৃথিবীর প্রথম ক্লোন মানবকন্যার নাম ইভ । যদিও সত্যিকার ভাবে মানব ক্লোন করা হয়েছে এরকম কোন প্রমাণ নেই, ২০০২ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ক্লোনাইড নামক একটি প্রতিষ্ঠান দাবি করে যে তারা প্রথম ক্লোন মানব শিশু তৈরি করেছে কিন্তু তারা এ সম্পর্কিত কোন তথ্য প্রকাশ করেনি, তবে যতদূর জানা যায়, এই মানব ক্লোনটি তৈরি করেছে একটি ৩১ বছর বয়স্ক মহিলার কোষ থেকে এবং এটি করা হয়েছে আমেরিকার বাইরে কোন উন্নয়নশীল দেশে, কারণ হিসাবে বলা হয় মহিলাটির স্বামী প্রজননে অক্ষম ছিল। এরপর ২০০৩ সালের ২৩শে জানুয়ারি ক্লোনাইড দাবি করে তারা আরো একটি মানব শিশু ক্লোন করেছে – জাপানের ২ বছর বয়সের এক বাচ্চার কোষ থেকে যে ২০০১ সালে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়, যদিও এ ব্যাপারে আর কোন তথ্য তারা প্রকাশ করেনি।
যাহোক, প্রথম হাইব্রিড মানব ক্লোনটি করা হয় ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে। এটি করা হয় অ্যাডভান্স সেল টেকনোলজির (ACT) মাধ্যমে, এবং এক্ষেত্রে মানুষের পায়ের কোষ থেকে নিউক্লিয়াস নিয়ে কুকুরের ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয় কিন্তু এটা ১২ দিনের মাথায় নষ্ট করে ফেলা হয়। এরপর ২০০৮ সালের জানুয়ারীতে ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত স্টিমাজেন কর্পোরেশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা স্যামুয়েল উড এবং অ্যান্ড্রিউ ফ্রেঞ্চ ঘোষণা দেন তারা থেরাপিউটিক ক্লোনিং এর লক্ষ্যে ৫ টি মানব ভ্রূণ তৈরি করেছে কিন্তু পরবর্তীতে তারা নৈতিকতার দিক বিবেচনা করে ভ্রুন ৫ টি নষ্ট করে ফেলে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে কিছু বিজ্ঞানী মানব ক্লোনিং কে ব্লাস্টোসাইট ধাপ পর্যন্ত নিয়ে যেতে সফল হন। বর্তমানে মানব ক্লোনিং সারা বিশ্বে (ডেনমার্ক ছাড়া) নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারণ এর সাথে নৈতিকতা ও মানবিকতা জড়িত।
শেষ কথা
বায়োটেকনোলজি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ ও সমৃদ্ধ করেছে। ক্লোনিং প্রক্রিয়া বায়োটেকনোলজির এক অনিন্দ্য সুন্দর শিল্প। এটি এমন এক বিষয় যা মানুষের অনেক বড় বড় কিছু সীমাবদ্ধতাকে দূর করেছে। তবে অ্যাটম বোমার যেমন ভাল-খারাপ দিক রয়েছে ঠিক তেমনি ক্লোনিং ও এই বিষয়ে কম যায়না। ভবিষ্যতে যদি মানব ক্লোনিং স্বীকৃতি পায় তাহলে এই পৃথিবী হবে এক নিদারুণ, অমানবিক জগৎ। তখন হয়তো ক্লোন মানব হবে গবেষণাগারের আজকের গিনিপিগ। বিভিন্ন প্রকার বায়ো-ক্রাইম এর ক্ষেত্রে ক্লোনিং মারাত্মক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে অনেক ভাল কিছুও করা সম্ভব। যদি বলা হয় একসময় এই পৃথিবীতে শুধু মেয়েরাই রাজত্ব করবে, তারা পুরুষদের সাহায্য ছাড়াই বাচ্চা প্রসব করবে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পুরুষরা বিলুপ্ত হতে থাকবে, তাহলে হয়তো খুব হাসি পেতে পারে কিন্তু এটা মোটেই অসম্ভব নয় বরং খুবই সম্ভব, কারণ প্রকৃতি মেয়েদেরকেই সম্পূর্ণ করে তৈরি করেছে। কারণ, এখনো পর্যন্ত ক্লোনিং এর প্রধান তিনটি উপাদানের দুটিই সম্পূর্ণ তাদের হাতে – ডিম্বাণু ও উর্বর জরায়ু। যাহোক, ক্লোনিং আছে বলেই আমরা বেশি বেশি গবেষণা করতে পারছি, ক্লোনিং এর মাধ্যমে তৈরি বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে অনেকেই মৃত্যুকে কাঁচকলা দেখাচ্ছি। আসলে, সব কিছুরই ভাল-খারাপ দিক আছে এবং থাকবে, আমাদের উচিত ভাল দিকগুলো কে গ্রহণ করা। Sudipto Sarkar
Post Creator- Sudipto /01817832965
তথ্য সুত্র
Science Daily-Dolly the Sheep. Web: http://sciencedaily.com/articles/d/dolly_the_sheep.htm. Viewed On: [March 7, 2014]
National Museum Scotland-Dolly the Sheep. Web: http://nms.ac.uk/our_collections/highlights/dolly_the_sheep.aspx. Viewed on: [March 8, 2014]
Roslin Institute-Dolly the Sheep: A Life of Dolly. Web: http://roslin.ed.ac.uk/public-interest/dolly-the-sheep/a-life-of-dolly/. Viewed On: [March 8, 2014]
Regina Bailey-Cloning Techniques. Web: http://biology.about.com/od/biotechnologycloning/a/aa062306a.htm. Viewed On: [March 8, 2014]