উড়োজাহাজের কৌশল
কাগজের প্লেন তো উড়িয়েছো? খাতার কাগজ ছিড়ে আম্মুর বকা না খেতে চাইলেও অন্তত দুষ্টু বন্ধুটাকে প্লেন উড়াতে দেখেছো নিশ্চয়ই। কার প্লেন কতক্ষণ বাতাসে থাকতে পারে সেই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মনে প্রশ্ন জাগতো টনকে টন ভারী সত্যিকার প্লেন কিভাবে আকাশ পাড়ি দেয়! বিমান বলতেই একটা মস্ত বড় পাখাওয়ালা জিনিস চোখে ভেসে ওঠে। এই মস্ত বড় পাখাগুলোতে বিশাল বিশাল ফ্যান থাকে। এগুলো অনেক জোরে ঘুরতে পারে। আমাদের বাসায় যে টেবিল ফ্যানগুলো আছে সেগুলো পিছন থেকে বাতাস টেনে সামনের দিকে আমাদের দিকে জোরে ছুঁড়ে দেয়। বিমানের ক্ষেত্রেও তাই। তবে এতে বাতাস পেছন থেকে সামনে বাতাস না দিয়ে উল্টো কাজ করে, সামনে থেকে পেছন দিকে বাতাস পাঠায়। এই বাতাসই বিমানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। আবার বাতাসে ভেসে থাকতেও সাহায্য করে।
আচ্ছা, বিমান কিভাবে উড়ে তা শেখার আগে নিজের মাথাটা একটু ঝালিয়ে নাও। তোমার কি মনে হচ্ছে? এত্তবড় একটা জিনিস কিভাবে আকাশে ভেসে থাকতে পারে?
চলো একটা সাধারন চিন্তা করি। যদি জিজ্ঞাসা করি আমরা কোন কিছু উপরে ছুঁড়ে দিলে তা নিচে পড়ে যায় কেন? নিশ্চয়ই একসাথে সবাই বলে উঠবে, অভিকর্ষ বলের কারনে। আচ্ছা আমরা যদি এই অভিকর্ষ বলের চেয়ে বড় কোনো বল বিপরীত দিকে প্রয়োগ করি তাহলে কী ঘটবে? নিশ্চয় বস্তুটি উপর দিকে উঠতে থাকবে। বিমানের ক্ষেত্রেও তো আমরা এমনটা করতে পারি। কিভাবে করবো সেটা বোঝার আগে নিচের ছবিটি দেখি।
এটা একটা বিমান এর উইং বা ডানার ক্রস সেকশনাল ছবি। বিমান যখন সামনে এগিয়ে যায় তখন এর উপর ও নিচ উভয় দিক দিয়েই বাতাস প্রবাহিত হয়। কিন্তু এর গঠনগত কারণে এর নিচের দিক দিয়ে অধিক পরিমাণ বাতাস প্রবাহিত হয় এবং উপর দিকে কম বাতাস প্রবাহিত হয়। তাই উপর দিকে বাতাসের বেগ নিচ অপেক্ষা বেড়ে যায়। এই বেগের পার্থক্য তৈরী হলে আমাদের লাভ কোথায়?
কোনো প্রবাহী পদার্থের (এক্ষেত্রে পাখার চারদিকের বায়ু) মোট শক্তির পরিমাণ সর্বদা সমান থাকে। মোট শক্তি? আসলে এখানে তিন ধরনের শক্তি কাজ করে। গতিশক্তি, স্থিতিশক্তি ও চাপশক্তি। এই তিনটা মিলে মোট শক্তি। ধরো, তোমারও এই তিন ধরনের শক্তি আছে যার যোগফল সর্বদা সমান থাকে। মনে কর মোট ১০ একক। এখন যদি গতি শক্তি ৫ একক আর স্থিতি শক্তি ৩ একক হয় তাহলে চাপ শক্তি স্বাভাবিকভাবেই ২ একক হবে। কোনোভাবে যদি গতিশক্তি ৬ একক করা যায় এবং স্থিতিশক্তি ৩ এককেই অপরিবর্তিত থাকে তখন চাপশক্তি ১ এককে নেমে আসবে।
বিমান উড়ানোর ক্ষেত্রেও এই ঘটনাই ঘটে।
নিচের তুলনায় উপরের অংশে স্থিতিশক্তির তেমন পার্থক্য থাকে না, কারণ দুই অংশের মধ্যে উচ্চতার পার্থক্য খুব কম থাকে।
পার্থক্য তৈরী হয় গতিশক্তিতে। উপরে বাতাস এর গতি নিচের চাইতে অনেক বেশি হওয়ায় গতিশক্তি অনেক বেশি হয়। উপর ও নিচের বাতাস এর মধ্যে শক্তির সমতা রক্ষা করতে হলে উপরের বাতাসের চাপশক্তি কমাতে হবে। তখন উপর দিকের চেয়ে নিচের দিকে চাপ বেশি হয়। ফলে বাতাস এর পক্ষ হতে উইং বা ডানা উপর দিকে ধাক্কা অনুভব করে। এই ধাক্কাই বিমানকে উপর ভাসিয়ে রাখে। আবার আমরা বুঝতে পারি বাতাস এর বেগ যত বাড়বে উপর দিকের গতিশক্তি তত বাড়বে, ফলে উপর ও নিচের চাপের পার্থক্য বাড়বে। তখন বিমান আরো উপরে উঠবে। এই মোট শক্তি সমান থাকার ব্যাপারটি Bernoulli নামক একজন বিজ্ঞানীর মাথা থেকে আসে। তাই এটা Bernoulli এর সুত্র নামে পরিচিত।
তাহলে তো বিমান এভাবে উপরে উঠতেই থাকবে!
বাতাসের চাপ আবার এর ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। যত উপর দিকে উঠা যায় বাতাসের ঘনত্বও তত কমতে থাকে। এমন সময় আসে যখন ডানা বা উইং এর উপর ও নিচের চাপের পার্থক্যের কারণে যে বল অনুভব করতো তা এর ভরের কারণে সমান বল নিচের দিকে অনুভব করে। তাই তখন তা সেই অবস্থাতেই থাকে, আর উপরে উঠেনা। এ পর্যন্ত আশা করে বুঝে ফেলেছো।
ডানার নিচের চেয়ে উপরের অংশ দিয়ে বাতাস বেশি বেগে প্রবাহিত হওয়ার কারণ কী?
আমরা জানি, যে কোনো ফ্লুইডের বেগ তার প্রবাহের পথে প্রযুক্ত চাপের সমানুপাতিক, অন্য কথায় তার প্রবাহ পথের প্রস্থচ্ছদের ক্ষেত্রফলের ব্যস্তানুপাতিক (V=Q/ A)। ঠিক যেমন বৈদ্যুতিক বর্তনীতে তড়িৎ প্রবাহ রোধের ব্যস্তানুপাতিক।
যদি প্রবাহের পথে কোন বাধা থাকে অর্থাৎ প্রবাহ পথ সংকুচিত হয়ে যায় তবে প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পায়। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে, একটা নল দিয়ে যখন পানি আসে তখন নলটা যদি চেপে ধরা হয় তবে পানির বেগ অনেক বেড়ে যায়। একই নীতি ব্যবহার করা হয় ইঞ্জিনের কার্বুরেটর কিংবা যেকোন স্প্রে (যেমনঃ এরোসল, বডি স্প্রে)’র ক্ষেত্রে। এই নীতির নাম “Venturi Principle”, যা কিনা ফ্লুইড মেকানিক্সের বিখ্যাত Bernoulli এর সমীকরনের ব্যবহারিক রূপ। ডানার উপরের বিশেষ ধরণের অর্ধবৃত্তাকার বা অধিবৃত্তাকার আকৃতির কারণে এর উপর দিয়ে যে বায়ুস্তর অতিক্রম করে তা বাঁধা পায় বা কম আয়তনের মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে ইবৎহড়ঁষষর নীতি অনুসারে এই বায়ুস্তরের বেগ বৃদ্ধি পায়।
বিমান ওঠা ও নামার সময় আবার একটু ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরী হয়। রানওয়ে থেকে উঠার সময় (এবং নামার সময়) প্লেনের গতি কম থাকে। এজন্য প্রয়োজনীয় চাপ তৈরী করার জন্য ডানার আয়তন বাড়ানো হয়। কিভাবে?
প্রতিটা ডানা’র নীচে আরও ছোট ছোট ডানা (Flap)লুকানো থাকে। প্লেন টেইক অফের সময় সেগুলো প্রয়োজনমত বের করা হয় যা টেইক অফের পর গুটিয়ে নেয়া হয়। ল্যান্ডিং এর সময়ও তাই।
পরেরবার প্লেনে ওঠার সময় জানালার কাছের সিট নিও। পুরো ব্যাপারটা খেয়াল করলে খুব মজা পাবে।