রসায়নের রস
| Sudipto Sarkar
তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। ক্লাসে একদিন গণিতের শিক্ষক এসে বললেন, জীবন গণিতময়; জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা গণিত ব্যবহার করি। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক বললেন, পদার্থবিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা নতুন স্বপ্ন দেখি। চিন্তা করে দেখলাম আসলেই তো, আমরা প্রাত্যহিক জীবনে এগুলোর ব্যবহার অহরহ করে থাকি। কিন্তু যখন রসায়ন শিক্ষকও একই কথা বললেন-“আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রসায়নের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি”! তখন ভেবেছিলাম স্যাররা সকলেই আত্মপ্রীতিতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার ভুল ভেঙেছিল স্যারের পরের কথায়- শরীরের রক্তে অক্সি-হিমোগ্লবিনের মিশ্রণ, রক্তের অম্লতা-ক্ষারতা সংরক্ষু, কোষে প্রোটোপ্লাজম-সাইটোপ্লাজম এর উপাদান বিনিময় সবকিছুই রসায়নের নিয়মের অন্তর্ভুক্ত ! জীবাণুনাশক তৈরি, সুগন্ধি তৈরি, বিভিন্ন খাবারের মান সংরক্ষু ছাড়াও আরও অনেক কাজে রয়েছে রাসায়নিক দ্রবণের অত্যধিক ব্যবহার।
একটু ভালভাবে চিন্তা করলেই দেখতে পাবে অসংখ্য রাসায়নিক দ্রবণ আমাদের জীবণকে সহজ থেকে সহজতর করেছে। কি জানতে ইচ্ছে করছে সেসব দ্রবন সম্পর্কে ? তাহলে চলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অধিক ব্যবহৃত এর কমই কিছু দ্রবণ সম্পর্কে জেনে নিই।
কোমল পানীয়
তোমাদের অনেকের প্রিয় এই পানীয়ের প্রধান উপাদান কার্বনেটেড পানি। এটি একটি গ্যাস-তরল দ্রবণ। উচ্চচাপে এবং নিম্ন তাপমাত্রায় কার্বন গ্যাসকে পানির সাথে দ্রবীভূত করা হয়। কোনভাবে চাপ কমে গেলে বা তাপমাত্রা বেড়ে গেলে গ্যাস বুদবুদ আকারে বেরিয়ে যায়। তাইতো পানীয়ের বোতল খোলার সাথে সাথে চাপ কমে যাওয়ায় কিছু কার্বন গ্যাস বেরিয়ে যায়। এছাড়াও এসব পানীয়তে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার অম্লতা সংরক্ষু করা হয়। এর কম অম্লতায় গ্যাস ধরে রাখা সম্ভব হয় না। ফলে কার্বনেটেড পানিতে কোনো ক্ষারক যোগ করা হলে গ্যাস বেরিয়ে যায়। কার্বনেটেড পানিতে খাবার লবণ যোগ করলে ক্ষার উৎপন্ন হয় যা দ্রবণের অম্লতা কমিয়ে দেয় এবং গ্যাস বেরিয়ে যায়। তাই এসব পানীয়তে লবণ যোগ করলে ঝাঁজ কমে যায়। যারা কোকাকোলা বা সেভেন-আপ কিনার পর কিছুক্ষন জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে তারপর বোতলের মুখ খুলেছে তারা ছাড়া অন্য কেউ হয়তোবা কোমল পানিয় খাওয়ার আসল মজাটা বুঝবে না।
বরফ দূরীকরণ
শীতপ্রধান দেশগুলোতে প্রায়ই বরফ ঝড় হওয়ায় রাস্তাঘাট, রেলপথ বরফে ঢেকে যায়। এগুলো অপসারণের বা প্রতিকারের পদ্ধতি হলো ডি-আইসিং (De-icing) এবং এ্যন্টি-আইসিং (Anti-icing)। ডি-আইসিং পদ্ধতিতে লবণের সাহায্যে বরফকে গলিয়ে ফেলে রাস্তা পরিষ্কার করা হয়। লবণ বরফ গলনের তাপমাত্রাকে কমিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সাধারণত খাবার লবণ (NaCl) ব্যবহার করা হয় যা বরফ গলন তাপমাত্রা-১৮ °C তে নামিয়ে নিয়ে আসে ফলে বরফ সহজে গলে যায়। বর্তমানে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড বা ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড লবণ ব্যবহার করা হয় যা গলন তাপমাত্রাকে আরও কমিয়ে দেয়। এন্টি-আইসিং পদ্ধতিতে বরফ জড় হওয়ার আগে রাস্তায় লবণ বিছিয়ে দেয়া হয় যা বরফ গঠন করতে দেয় না। শীতপ্রধান দেশে নিম্ন তাপমাত্রার কারনে পাইপ লাইন, ইঞ্জিনে জ্বালানিতে মিশ্রিত পানি কঠিন অবস্থা ধারণ করে। জ্বালানিতে সঠিক মাত্রায় অ্যালকোহল যোগ করলে এই সমস্যা নিরসন হয়। কিন্তু অ্যালকোহল মিশাতে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং অন্য লাভজনক ডি-আইসিং পদ্ধতি ব্যবহার করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়। সোডিয়ামের কথা বলতে বলতে একটা কৌতুক মনে পরে গেল। একবার ক্লাসে এক শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আচ্ছা সোডিয়ামের সংকেত কি তুমি বলতে পারো ?’ তখন ছাত্রটি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো, ‘Na’।
ফরমালিন
ফরমালিনের সাথে আমরা বহুল পরিচিত। এটি পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেলে প্রায়ই আলোচনার বিষয়। ফলমূল, মাছ, শাক সবজিতে এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নাগরিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে চলেছে। এটি মূলত মিথান্যাল বা ফরমালডিহাইড (HCHO) এর ৪০% দ্রবণ। অতি সহজেই এই কার্যকরী দ্রবণ তৈরি সম্ভব! যুক্তরাষ্ট্রের একটি তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী এর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১৬ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি ! কাঠ বা কন্সট্রাকশন কারখানায় শক্তকারক বস্তু হিসেবে, পোশাক শিল্পে পোশাক সাদাকরণে ও ফিনিশার হিসেবে, ছত্রাকনাশক এবং জীবাণুনাশক হিসেবে, এমনকি মৃত মানবদেহ সংরক্ষণে এর ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু খাদ্যদ্রব্যে এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে শোনা যাচ্ছে বাজারে নাকি আজকাল বেজাল ফরমালিনও পাওয়া যাচ্ছে।
রাজ অম্ল
স্বর্ণ, প্লাটিনাম অত্যন্ত নিষ্ক্রিয় এবং মূল্যবান ধাতু। এরা এতই নিষ্ক্রিয় যে অনেক শক্তিশালী এসিডের সাথেও এরা বিক্রিয়া করে না। একটি দ্রবণ রয়েছে যা এসব মৌলকে গলিয়ে ফেলে অর্থাৎ এদের সাথে বিক্রিয়া করে! যা রাজ অম্ল বা একোয়ারেজিয়া নামে পরিচিত। এটি ১ অণু নাইট্রিক এসিড (HNO3) এবং ৩ অণু হাইড্রক্লোরিক এসিড (HCl) এর সমন্বয়ে গঠিত হয়। এটি মূলত শক্তিশালী জারক হিসেবে কাজ করে এবং নিষ্ক্রিয় ধাতুদের সাথে বিক্রিয়া করে। স্বর্ণ বিশুদ্ধকরণে এবং ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন পাত্র পরিষ্কারক হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়।
জীবণুনাশক
জীবাণুনাশক হিসেবে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রবণের ব্যবহার অত্যধিক। ইথানল (৬০-৯০%), ১-প্রোপানল (৬০-৭০%), ২-প্রোপানল (৭০-৮০%) অথবা এদের মিশ্রণকে সার্জারিক্যাল অ্যালকোহল বলা হয় কারণ এগুলো সার্জারি পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। টিংচার আয়োডিন, ফেনল, বোরিক এসিড, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড-এর বিভিন্ন মাত্রার দ্রবণ ইত্যাদি বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রবণ জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বহুল ব্যবহৃত ডেটল বেনজিনের একটি জাতক (C8H9ClO) আইসোপ্রোপানল, পাইন তেল এবং পানির মিশ্রণে তৈরি করা হয়।
এইসব রাসায়নিক দ্রবণের কথা চিন্তা করতে করতে অনেকের মাথার মধ্যে হয়তোবা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরণের দুষ্টামি চলে এসেছে। যারা রসায়নকে রসকসহীন সাবজেক্ট বলে মনে করে এসেছো তাদের মধে হয়তোবা এই ভূল ধারণা ভেঙ্গে গেছে। যাই হোক না কেন শেষ করার আগে একটা কাজ দিয়ে যাচ্ছি, কেউ যদি পানি ও তেলক একসাথে মিশাতে পারো তা হলে আমাকে জানাতে কিন্তু ভুলবে না। বুঝলে ?